২০১৩/০২/২০

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা - আব্দুল লতিফ


দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়,
দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি
জানা আছে জগৎময়,
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারো দানে পাওয়া নয়।

সতেরোশো সাতান্ন সনে,
ভাইবা দেখেন পড়বে মনে
দাম দিছি পলাশীর মাঠে
ইতিহাস তার সাক্ষী রয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা …

সেইবারে জানিল বিশ্ব আমরা কত ধনী রে
দান করিতে লক্ষ জীবন তুচ্ছ বলে গণি রে
আঠারোশো সাতান্ন সালে
দাম দিছি ফের জানে মালে
ওরে পিছন ফিরে চাইলে পরে’ একশ বছর কথা কয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা….

ব্রিটিশ গিয়া সইপ্যা গেল জল্লাদেরই হাতে রে
তারা মোদের খুন কইরাছে না না অযুহাতে রে
লক্ষ করুণ হাসি হাসি
খাইছে গুলি পরছে ফাঁসি
তবু না দুঃখিনী বাংলা তোমার আমার কারো হয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা…

বায়ান্নোতে মুখের ভাষা কিনছি বুকরে খুনে রে
বরকতেরা রক্ত দিল, বিশ্ব অবাক শোনে রে
দিছি রক্ত জন্মাবধি
কত সাগর সাগর নদী নদী
রক্তে বাংলা লাল কইরাছি এই কথা তো মিথ্যা নয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা…

ঊনিশশো একাত্তর সালে পঁচিশে মার্চ রাতে রে
মেয়ের মায়ের বোনের ইজ্জত লুইটাছে ডাকাতে রে
বাপের সামনে বলুক তো ঝুট!
মেয়ের ইজ্জত হয়নি কি লুট?!
আজো বাংলার আকাশ বাতাস দুঃখে শোকো উদাস হয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা…

দাম দিয়াছি মায়ের অশ্রু বোনের সম্ভ্রম রে
ওরে বলতে কি কেউ পারো রে ভাই
দাম কি কারও কম রে?
কত কুলের কুলাঙ্গনা নাম নিয়াছে বীরাঙ্গনা
দুঃখে বাংলার পদ্মা মেঘনা যমুন যে উজান বয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা…

দাম দিয়ছে বুদ্ধিজীবি নামী দামী লোক কত
এই জনমে ফুরাবে কি আমার বুকের সেই ক্ষত!
ঊনিশশো একাত্তর সনে ওরে ষোলই ডিসেম্বর সকালে
অবশেষে দুঃখিনী এই বাংলা মা যে আমার হয়
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়।

কথাঃ আব্দুল লতিফ
সুরঃ আব্দুল লতিফ
মূল শিল্পীঃ আব্দুল লতিফ

২০১৩/০২/০৬

হুলিয়া-নির্মলেন্দু গুণ

কবিতাঃ হুলিয়া 

কবিঃ নির্মলেন্দু গুণ


আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷
আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷
পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷
পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -৷
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷
মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷
মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
– আমাদের ভবিষ্যত্ কী?
– আইয়ুব খান এখন কোথায়?
– শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?
– আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?
আমি কিছুই বলবো না৷
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷
উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিত্কার করে
কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:
‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি – নির্মলেন্দু গুণ

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি – নির্মলেন্দু গুণ

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

ইতিহাস-আখতারুজ্জামান আজাদ

 ইতিহাস-আখতারুজ্জামান আজাদ

আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি –
না ঘরে, না বাইরে;
না বাইরে, না ভিতরে;
না ভিতরে, না ইতরে!
আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি –
না নরের, না নারীর;
না আত্মীয়ের, না আততায়ীর;
না আস্তিকের, না নাস্তিকের;
না কবির, না নবির।
আমার গলা নারীর বন্দনাগীত গায়নি,
জিভ থেকে পুরুষের স্তবক বেরোয়নি,
আমার হাত কারো পা ছোঁয়নি,
চোখ কারো ভণ্ডামো এড়ায়নি,
ঠোঁট ঢুকে পড়েনি অপঠোঁটে,
একনায়িকার খামখেয়ালে আমার শরীর করেনি ওঠবস,
আমার মগজ কাউকে দেয়নি পূর্ণ বা খণ্ডকালীন দাসখত!
আমার আত্মঘাতে ঘা খেয়ে উঠেছে পেশিবহুল পুরুষও,
আমার বিষবাক্যে চিত্‍কার করে উঠেছে পূজাপ্রত্যাশী নারীও!
ধুতি-টুপিতে টান পড়ায় শীত্‍কার করে উঠেছে ধর্মজীবী ধার্মিকও,
অজ্ঞাতনামা রোগে রাগান্বিত হয়ে উঠেছে নার্সিসাস নাস্তিকও!
অবশেষে,
আমি কখনোই কারো প্রিয় হতে পারিনি!
তোষামুদে-জন প্রিয় হয় সবার, এই হলো পরিহাস;
তোষামোদ করিনি কখনোই আমি, এই হলো ইতিহাস!

ভাষার-কবিতা || মাতৃভূমির জন্য-সৃজন সেন

 মাতৃভূমির জন্য  || সৃজন সেন

 
আমার বয়স তখন কতোই বা !
চার কিংবা পাঁচ।
অথচ আমার স্মৃতিকে আজও অন্ধকার করে দেয়
সেই সময়ের এক রাশ কালো ধোঁয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে যে ধোঁয়া-
আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল,
আমাদের বাড়ির শেষপ্রান্তে
বুড়ো বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে
সবাই ভিড় করে সেই ধোঁয়া দেখছিল,
আমিও মায়ের কোলে চড়ে সেই ধোঁয়া দেখছিলাম,
সবাই আতঙ্কে ‘রায়ট লাগছে, রায়ট লাগছে’ বলে
ছোটাছুটি করছিল
এবং তার কদিন পরেই
সদ্য-বিবাহিত দাদা-বৌদির সঙ্গে
আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাকে, আমার বাবাকে
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমাদের সেই বুড়ো বটগাছ,
টিনের চালাওয়ালা গোবরলেপা বেড়ার ঘর,
বাড়ির পেছনের পুকুর,
পুকুরপাড়ের নোনা গাছ
এবং আমার প্রিয় কাজলা দিদিকে,
ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাতৃভূমিকে,
আমার জন্মভূমিকে।
আর সেদিনের পর থেকে
একদিনের জন্যও আমি আর ওই জন্মভূমিতে
ফিরে যেতে পারিনি,
একবারের জন্যও না।
এখন আমার স্মৃতিতে সব কিছু ঝাপসা-
সেই ঘর, সেই গাছ, সেই কাজলাদিদি,
… সব, সব !
চাঁদপুর থেকে স্টিমারে,

ভাষার-কবিতা||আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি-কবি মাহবুবুল আলম



আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি ||কবি মাহবুবুল আলম

এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে
একুশের প্রথম কবিতা যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে রক্তের আলপনা,
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।

আজ আমি শোকে বিহ্বল নই,                   
আজ আমি ক্রোধে উম্মত্ত নই,
আমি আজ রক্তের গৌরবে অভিষিক্ত।...

যে শিশু আর কোনদিন তার পিতার কোলে
ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না,
আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি ||কবি মাহবুবুল আলম

যে গৃহবধূ আর কোনদিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায়
আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর
দাঁড়িয়ে থাকবে না,

যে জননী খোকা এসেছে বলে উদ্দাম আনন্দে
সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে
পারবে না,

যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়বার আগে বার বার
একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে
আনতে চেষ্টা করেছিল,

তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবী করতে এসেছি
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমি তাদের
ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি

যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে হত্যা করেছে,
যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায়
অভ্যস্ত মাতৃ সম্বোধনকে
কেড়ে নিতে গিয়ে
আমার এইসব ভাইবোনদের হত্যা করেছে,
আমি তাদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি।
[আংশিক]
একুশের প্রথম কবিতা এটি ।

২০১৩/০২/০৩

তাহারেই পড়ে মনে – বেগম সুফিয়া কামাল



তাহারেই পড়ে মনে – বেগম সুফিয়া কামাল Tahare Pore Mone - Sufiya Kamal

“হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ

তাহারেই পড়ে মনে – বেগম সুফিয়া কামাল

এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।”

কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”

কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”

“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”